দুস্থ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত এরা সকলেই গবাদিপশু পালন করে থাকেন। তাদের পর্যাপ্ত নেই কোনো নিজস্ব চাষা জমি। অথচ পশু পালন করে বছরের বড় অংশের জীবন-জীবিকা চলে প্রান্তিক ওইসব মানুষদের। এরপরেও প্রাকৃতিক গোখাদ্যের উপর ভরসা করে পশু পালন করে আসছেন তারা। আর বিত্তবানদের ভূমি থাকলেও তারা পশুর পালন করছেন বন বিভাগের বনায়নে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছন্ন উপজেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে গবাদিপশুর চুরি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
যার কারণ হিসেবে স্থানীয় পশু পালনকারীরা বলেছেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী গোখাদ্যের যোগান দিতে পারছেন না তারা। ফসলি জমির আবাদ বেড়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক গোখাদ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। যার জন্য পশু পালনের জন্য চরাঞ্চল কিংবা বন বিভাগের বনায়নে গবাদিপশুর পাল রাখলেও চোর চক্রের তৎপরতায় অতিষ্ঠ তারা।’ তবে সম্প্রতি গরু ও মহিষ চুরি করে নিয়ে যাওয়া সময় ১০টি গবাদিপশুসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ।
অন্যদিকে, গো-খাদ্যের সঙ্কট মোকাবিলায় উন্নত জাতের ঘাস চাষের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেয়ার কথা জানান উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য মতে, ‘৭০ হাজার গরু, ১৫ হাজার মহিষ, ১৫ হাজার ছাগল ও ৫ হাজার ভেড়া রয়েছে।’ এছাড়া উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, ‘চলতি বছরে ৪৭ হাজার ৪ শ’ ৪ হেক্টর জমির মধ্যে ৩০ হাজার ১৬০ হেক্টর জমি আবাদ করা হয়। আর ১৭ হাজার ২৪৪ হেক্টর জমি চরাঞ্চল ও বন বিভাগের আওতায় রয়েছে।’
রাঙ্গাবালী থানার রেকর্ড বলছে, ‘২০২১ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৮টি গবাদিপশু চুরির ঘটনায় ১২টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি গরু উদ্ধার করেছে পুলিশ।’
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘পশু চুরির সংখ্যা আরো বেশি।’
গবাদিপশু পালনকারীরা জানায়, ‘গত কয়েক বছর থেকে মাঠ এবং চরাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ধরনের গোখাদ্য কমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। মাঠ কিংবা চরাঞ্চলের পতিত জমির ঘাসের ওপর নির্ভর করে গোখাদ্যের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে অত্র এলাকার গবাদিপশু লালন-পালনের ওপর নির্ভরশীল কমপক্ষে কয়েক হাজার পরিবার। এমন পরিস্থিতিতে বাজার থেকে দানাদার খাবারের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী এবং দুধের বাজারমূল্য কম হওয়ায় গবাদিপশু পালন করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, গবাদিপশু লালন-পালনের ওপর নির্ভর পরিবারগুলো রয়েছে চরম দুশ্চিন্তায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান, ‘বন বিভাগের আওতাভুক্ত বনায়নের ভিতরে ঘাস থাকলেও সে সকল ঘাসের জন্য সংশ্লিষ্ট বিট কর্মকর্তাকে ম্যানেজ না করলে বনের মধ্যে গবাদিপশু প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। যারা ম্যানেজ করতে পারে তারাই কেবল বনের ভিতরে ঘাস খাওয়াতে পারে।’
জানা গেছে, গবাদিপশুর খাদ্যের প্রধান উৎস ছিল চরাঞ্চলের প্রকৃতিক খাবার। এক সময় মাঠজুড়ে সবুজ ঘাসের সমারোহ আর চরাঞ্চলে হাজারো গবাদিপশুর অবাধ বিচরণ ছিল নিয়মিত যা এখন কমে গেছে। বিস্তীর্ণ মাঠ কিংবা চরাঞ্চলে এখন আর নেই প্রাকৃতিক ঘাস। কারণ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভাঙন, জলকপাট থেকে লবনপানি প্রবেশ করে জলাবদ্ধতা, মাছের ঘের ও তরমুজ আবাদ বেড়ে যাওয়ায় গবাদি পশুর চারণভূমির সঙ্কটের কারণে গোখাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে করে এলাকার হাজার হাজার কৃষক ও গোখামারি হিমশিম খাচ্ছেন পশু পালনে। যেহেতু জমির আবাদ বেড়েছে সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে বন বিভাগের বনায়নে পশু পালন করছেন অনেকে। আর নিয়মিত যত্ন আর খাবার দিতে না পারায় নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষজন বিপাকে পড়েছেন। রাঙ্গাবালী হতে যে সকল গবাদিপশু চুরির ঘটনা রয়েছে এসব পশু অধিকাংশ বন থেকে যায়।
রাঙ্গাবালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) গবাদিপশু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময়ে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে গবাদিপশুসহ তিনজনকে আটক করা হয়। এই চক্রটি সক্রিয়। বিশেষ করে গবাদিপশু চুরি রোধ করার জন্য নানা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহে গিয়ে সচেতনামূলক প্রচার করা হয়েছে। এই এলাকার পশু পালনকারীরা অসচেতনা ও অসাবধানতার কারণে চুরি হার বেড়েছে। এই চোর চক্র নির্মূলে আমাদের অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সৌরভ কুমার ঘোষ বলেন, ‘লবণাক্ততা, মাছের ঘের ও তরমুজের আবাদ বেড়ে যাওয়ায় গরুর চারণভূমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। দানাদার খাবারের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় গোখাদ্যের সঙ্কট মোকাবিলায় উন্নত জাতের ঘাস (নেপিয়ার, পাক চং) চাষে গবাদি পশু পালনকারীদের উদ্বুদ্ধ করছি।’
এছাড়াও বিকল্প হিসেবে উন্নত পদ্ধতিতে ঘাস চাষের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেয়ার কথাও জানান তিনি।