রুপন কর অজিতঃ দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বরিশালেও কমেছে তাপমাত্রা, বেড়েছে শীতের প্রকোপ। তীব্র শীত ও বৃষ্টিতে জেলার জনজীবন এখন বিপর্যস্ত। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে ছিন্নমূল ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। গত রবিবার (১৪ জানুয়ারি) বরিশাল বিভাগের মৌসুমের সর্বনিম্ম তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। কুয়াশা,বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়ায় জেলার জনজীবন পড়েছে চরম বিপাকে। এছাড়া শীতের তিব্রতা বাড়ায় বরিশালের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দেয়া হয়েছে বন্ধ ঘোষণা।
বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।ফলে শীতের তীব্রতা বাড়তে পারে।আগামী কয়েক দিনে শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক মো. মাসুদ রানা রুবেল জানান, তীব্র শীতের কারণে বরিশালসহ আশপাশের এলাকা ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকতে পারে। এ মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় বাড়তে পারে শীতের তীব্রতা। কুয়াশায় মানুষের দৃষ্টিসীমা কমে এসেছে ৫০ মিটারে আগামী ৪-৫ দিন শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেন তিনি।এছাড়া আবহাওয়া দপ্তর বলছে মঙ্গলবারের আগে পরিস্থিতি উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই।
এদিকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে বিদ্যালয় বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও বরিশালে সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা দেয় কিন্তু খোলা রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো।
এবিষয়ে বরিশাল প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মিজ নিলুফার ইয়াসমিন বলেন,বরিশালের কোথাও ৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা আমরা পাচ্ছি না।জেলা অফিসারদের নির্দেশনা দেওয়া আছে ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে স্কুল বন্ধ করে দিতে।আমরা আবহাওয়া অফিসে যোগাযোগ করে পেয়েছি ১০ ডিগ্রির উপরে।
মাধ্যমিক জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসাইন জানিয়েছেন, তাপমাত্রা হ্রাস ও বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করায় মাধ্যমিক শ্রেণির সব বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত কয়েক দিনের কনকনে আবহাওয়ায় কাবু হয়ে গেছে এই অঞ্চলের মানুষ। মৌসুমের বৈরী আচরণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছেন ছিন্নমূল ও নিম্নআয়ের মানুষ।
বরিশাল লঞ্চঘাটের ১৩ বছর বয়সি এক শিশু বলে এই ছেড়া কম্বলে শীত মানছে না তাই আগুন জালিয়ে গা গরম করছি। কিন্তু ঠান্ডা বাতাসে ঠিক মত আগুন ও জ্বলেনা। তাই খুবই কষ্টে আছি।
বরিশাল লঞ্চঘাটের ঘুমানো এক বৃদ্ধা জানান,এতো শীতে বাঁচা মুস্কিল।যদি এই শীতে মরে যাই তাই যেনো কম্বল পেচাইয়া কবর দেয়।
বরিশালে শৈত্যপ্রবাহতে চরম বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তবে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। প্রয়োজন ছাড়া অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
নগরীর হাসপাতাল গুলোত বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্তদের ভিড়। গত ৭ দিন ধরে এর তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর চাপও বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শিশু এবং বয়স্করা।
বৃহস্পতিবার সকালে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি শয্যায় শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে রাখা হয়েছে অনেক শিশুকে। রোগীর চাপে নার্স ও চিকিৎসকরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
হাসপাতালের শিশু বিভাগে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্স নন্দিতা জানান,এবার ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন কম বেশি ৩০-৪০টি শিশু নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে।
বানারীপাড়া থেকে ৭মাস বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে আসা আলেয়া জানান,গত কয়েক দিন ধরে সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ অবস্থার অবনতি হওয়ায় মঙ্গলবার বিকালে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। শীতের কারণে নিউমোনিয়া হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানান।
হাসপাতালের সুত্রে জানা যায়, গত ১২ জানুয়ারি ৩১ শিশু ভর্তি হয়েছিল, এর মধ্যে একজন মারা যায়। ১৩ জানুয়ারি ভর্তি হয়েছিল ৩০ শিশু, মারা যায় এক শিশু। ১৪ জানুয়ারি ৩১ শিশু ভর্তি হয়েছিল, মারা গিয়েছিল এক শিশু। ১৫ জানুয়ারি ৩০ শিশু ভর্তি হয়েছিল। ১৬ জানুয়ারি ৩১ শিশু ভর্তি হয়েছিল, মারা গিয়েছিল এক শিশু। ১৭ জানুয়ারি ৩০ শিশু ভর্তি হয়, মারা গেছে এক শিশু। বাকিদের অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। তবে চলতি মাসে ১২ জানুয়ারির আগে আরো দুই শিশু মারা যায়। সবমিলিয়ে চলতি মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময়ে মারা গেছে সাত শিশু। এছাড়া চলতি মাসে ভোলা ও ঝালকাঠিতে ঠান্ডাজনিত রোগে আরো ৩ শিশু মারা গিয়েছে বলে জানাযায়।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু। জ্বর ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত তারা। শিশু ওয়ার্ডে শয্যার সংখ্যা অপ্রতুল। এজন্য অধিকাংশ রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। আমরা শিশু বিভাগে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল তিনি বলেন,‘শীতের তীব্রতা বাড়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে বিভাগজুড়ে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।চলতি মাসে এই পর্যন্ত নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে চার হাজারের বেশি রোগী বিভাগের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে সুস্থ হয়েছেন। চলতি মাসে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে গ্রাম অঞ্চলে ঘনকুয়াশায় নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেত। দুর্ভোগে ছিন্নমূল আর খেটে খাওয়া মানুষ। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় মরছে বীজতলার চারা। সময় মতো বোরো আবাদ নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা।কৃষকরা জানান, শীতের কারণে বীজ বপন করা যাচ্ছে না। আর ঘন কুয়াশায় বীজতলা নষ্ট হওয়ার পথে।