শেখ হাসিনার পতনের একমাস আর ড. ইউনূস সরকারের প্রথম ২৬ দিন, কোন পথে এগোচ্ছে ‘নতুন বাংলাদেশ’

- আপডেট সময় : ০৮:৫৮:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৯৩ বার পড়া হয়েছে

ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী উত্তাল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে গুঁড়িয়ে যায়। দেড় দশকের ওই স্বেরাচারী সরকারের ভয়াল থাবা আর লুটপাট রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে। গুম-হত্যা-নিপীড়নের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় আগেরকার সরকারের সব রেকর্ডকে। এসব কিছু পেছনে ফেলে ঝেড়ে ফেলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে দেশের স্বার্থে তা সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
নতুন সূচনার প্রস্তুতি নিয়ে ড. ইউনূসের অস্থায়ী প্রশাসন আন্দোলন পরবর্তী দেশকে স্থিতিশীল করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জর্জরিত এই দেশকে মেরামতের বড় স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে ড. ইউনূসের অদম্য হৃদয়। যা প্রতিনিয়ত শাণিত হচ্ছে ছাত্র-জনতার বৈষম্যহীন মানবিক দেশ গড়ার প্রত্যয় দিয়ে।
নতুন সরকারের ২৬তম দিনে বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) সচিবদের সৃজনশীল হওয়ার পরামর্শ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এক্ষেত্রে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান যেমনটি আগে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের মুখে শোনা যায়নি। তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে (সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) প্রথমবারের মত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে করেন ড. ইউনূস।
সভায় সচিবদের উদ্দেশ্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, চিন্তার সংস্কার করে, সৃজনশীল উপায়ে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বৈষম্যহীন মানবিক দেশ গড়ার যে প্রত্যয়, যে ভয়হীন চিত্ত আমাদের উপহার দিয়েছে, তার ওপর দাঁড়িয়ে বিবেক ও ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে, সেবা সহজীকরণের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ৫ আগস্ট সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে গেলে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস দেশে এসে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন এবং ৮ আগস্ট শপথ নেন। এই যাত্রায় ইউনূসের সঙ্গী হয়েছেন ২০ উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা মোট ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজের হাতে রেখেছেন ৮৬ বছর বয়সী ড. ইউনূস।
নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের বাছাইকরণ প্রক্রিয়ায় কিছু বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে: স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্বতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখা: প্রথমত উপদেষ্টাদের এই পরিষদটি ক্ষমতাচ্যুত আ. লীগের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গড়ে উঠেছে। এই দলের ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই তৈরি হয়েছে। দলটি তার ৫৩ বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশকে শাসন করে এবং সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে বড় সমর্থন আদায় করে নেয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এখন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র এবং স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নেয়। উদাহরণস্বরূপ, ড. ইউনূস সরকার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার স্মরণে বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে বিবেচিত ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল করে। সেইসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তায় যে বিশেষ আইন ছিল তা বাতিল করা হয়।
প্রসঙ্গত, ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তখনকার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান-সহ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ছ’জন শীর্ষ বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপরই পদত্যাগে বাধ্য হন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং দেশ ছাড়েন। এদিকে, প্রধান বিচারপতি পদে শপথ নেয়া বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এতটাই জনবান্ধব যে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম জয় ও সিরিজ জিতে হোয়াইটওয়াশ করায় বাংলাদেশ দলকে এজলাসে বসেই অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন মন্ত্রিসভা আর্থিক প্রেক্ষিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে অর্থনীতির ওপর বেশি জোর দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী এই সরকার বাংলাদেশের মূল উদ্বেগকে মোকাবিলা করার জন্য মানবাধিকারের ওপর জোর দিয়েছে। গুম থেকে দেশের নাগরিকদের রক্ষায় গুম ও নির্যাতন বিষয়ক কনভেনশনে প্রথমবারের মতো সই করেছে বাংলাদেশ। ২৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স সনদে সই করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক সভায় উপদেষ্টাদের করতালির মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এই চুক্তিতে সই করেন। এ সময় ড. ইউনূস বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক ‘গুম প্রতিরোধ দিবস’ এর এক দিন আগে চুক্তিটিতে সই করে জনতার দাবির সঙ্গে এক হয়ে যায় এই সরকার। এর আগে, চলতি সপ্তাহের শুরুতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে বলপূর্বক গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠন করে এই অন্তর্বর্তী সরকার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ৯টি সনদের ৮টিতে সই করেছে বাংলাদেশ। তবে জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের অনুরোধের পরও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গুমবিরোধী সনদে সই করেনি।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন অবশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার প্রচেষ্টায় ছাত্র-জনতার দীর্ঘ দাবির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে নতুন দিনের পথে আগামী দিনের বাংলাদেশ।
একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে নিয়মিত দায়িত্ব পালন এবং তিন মাসের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন সুনিশ্চিত করা। সেই লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছে এই সরকার। এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকার ২০ জন সম্পাদককের সঙ্গে আলোচনা করেন ড. ইউনূস। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ন্যূনতম দুই থেকে তিন বছর হতে পারে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার একাধিক সম্পাদক। তবে বেশিরভাগ সম্পাদক বলেছেন, অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের দ্বারা অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নির্ধারণ করা উচিত। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তারা এমন অভিমত প্রকাশ করেন। সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকার ২০ জন সম্পাদক অংশ নেন। আমন্ত্রিতদের দুজন দেশের বাইরে অবস্থান করায় অনুপস্থিত ছিলেন।
অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান কার্যনির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; নারী অধিকারকর্মী ফরিদা আখতার; মানবাধিকার কর্মী ও অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা আদিলুর রহমান খান; ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশী দেওবন্দী ইসলামী চিন্তাবিদ এএফএম খালিদ হোসেইন; গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টি নুরজাহান বেগম; মানবাধিকার সংস্থা ব্রতীর প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ; বীর প্রতীকে ভূষিত মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম; ছাত্রকর্মী এবং ২০২৪ সালে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুতকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল সংগঠক নাহিদ ইসলাম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল সংগঠক আসিফ মাহমুদ; বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাপক আসিফ নজরুল; সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী হাসান আরিফ; বাংলাদেশের সাবেক নির্বাচন কমিশনার (২০০৭-২০১২) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন; পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা; মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ও হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক বিধানরঞ্জন রায় এবং সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন।