০৫:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বরিশালের ২২ গ্রামে পেয়ারার রাজত্ব

বরিশাল সংবাদ বার্তা কক্ষ
  • আপডেট সময় : ০৩:২৯:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৬৯ বার পড়া হয়েছে

এখন পেয়ারার মৌসুম। এ সময় ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির পেয়ারা হাটগুলো। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির পেয়ারা স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে আসছে। বরিশাল জেলার বানারীপাড়া ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার ২২টি গ্রামজুড়ে দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারা বাগান অবস্থিত। স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, ধলহার, কঠুরাকাঠি গ্রাম এবং ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ২২টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। আটঘর-কুড়িয়ানা বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারাসমৃদ্ধ গ্রাম। এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গইয়া কিংবা শবরি বলা হয়। তবে জাতীয়ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা চারটি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।
আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রের অর্ধেক– এই আড়াই মাস জমে ওঠে পেয়ারা বেচাকেনা। পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ছোট-বড় ব্যবসাকেন্দ্র ও হাট। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম। এ মোকামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– আটঘর, কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙিতে করে সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে এসে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। পাইকাররা তা কিনে ট্রাক ও ট্রলারযোগে নিয়ে যান ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। আটঘর-কুড়িয়ানাখ্যাত বাগান থেকে ছোট ও মাঝারি নৌকায় করে বিপুল পরিমাণ পেয়ারা ভিমরুলীর ভাসমান হাটে নিয়ে আসেন চাষিসহ বাগান পর্যায়ের ক্রেতারা। সেখান থেকে পাইকারসহ খুচরা ব্যবসায়ীরা পেয়ারা কিনে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন বাজারে। ট্রলার ছাড়াও লঞ্চ, বাস, পিকআপ ও ট্রাকে করেও ভিমরুলী থেকে পেয়ারা যায় দেশের বিভিন্ন বাজার ও মোকামে। আটঘর-কুড়িআনার এ পেয়ারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গত এক দশক ধরে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার আগরতলা বাজারেও বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, এ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়ারার চাষ হয় পিরোজপুরের নেছারাবাদে। এ উপজেলায় ৬০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে অন্তত ৭ হাজার ৬৫৬ টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। ঝালকাঠি সদরে ৫৯১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৬ হাজার ৩৫৫ টন ও বরিশালের বানারীপাড়ায় ২১০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ২ হাজার ৯৪০ টন পেয়ারা। সব মিলিয়ে এ তিন উপজেলায় এক হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে ১৬ হাজার ৯৫১ টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়; যার দাম প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি।
স্থানীয় প্রবীণ কৃষক লাল মিয়া জানান, ষাট-সত্তর দশকে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো হতো লঞ্চে। আশির দশকে ঝালকাঠি থেকে স্টিমারে তুলে দেওয়া হতো পেয়ারা। নব্বই দশকে বানারীপাড়ার জম্বুদ্বীপ থেকে প্রতিদিন দু-চারটি পিকআপে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো শুরু হয়। পরে ২০১৬ সালে মিনি ট্রাক এবং ২০১৯ সাল থেকে বড় ট্রাকের ব্যবহার শুরু হয়। এখানকার আড়তদারদের মতে, লঞ্চ-ট্রাক যে পথেই পাঠানো হোক, ঢাকার ভোক্তাদের কাছে পেয়ারা পৌঁছাত এক দিন পর। দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়ায় এ সময়ের মধ্যে পেয়ারার রং-স্বাদ নষ্ট হতো। পচে যেত অর্ধেক পেয়ারা। এতে চাষিরা ন্যায্য দাম পেতেন না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এখন সকালে গাছ থেকে সংগৃহীত পেয়ারা দুপুরের আগেই পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকায়। এতে রং-স্বাদ দুটিই থাকছে অটুট।
আটঘর কুড়িয়ানা এলাকার চাষি নিজামুদ্দিন জানান, আগে পেয়ারা আর লেবু বিক্রি করে কম দাম পেতাম। এ কারণে পেয়ারা বাগান পরিবর্তন করে অন্য কিছু চাষাবাদের চিন্তা করছিলাম। এখন সেই চিন্তা বাদ দিয়েছি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে দাম। ফলে আমরা লাভবান হতে শুরু করেছি।
স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ জানান, নেছারাবাদের ২২টি গ্রামে ৬০০ হেক্টর জমিতে গড়ে ১০ টন করে পেয়ারার ফলন হচ্ছে। প্রতি মণ পেয়ারা ৩৫০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেয়ারা বাগানে ফুল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সার্বক্ষণিক মাঠে কৃষি কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের সহায়তায় কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। সার, কীটনাশক ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। পেয়ারা চাষ করে এ অঞ্চলের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

Add

বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

Barisal Sangbad

বরিশাল সংবাদের বার্তা কক্ষে আপনাকে স্বাগতম।

বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন

বরিশালের ২২ গ্রামে পেয়ারার রাজত্ব

আপডেট সময় : ০৩:২৯:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এখন পেয়ারার মৌসুম। এ সময় ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির পেয়ারা হাটগুলো। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির পেয়ারা স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে আসছে। বরিশাল জেলার বানারীপাড়া ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার ২২টি গ্রামজুড়ে দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারা বাগান অবস্থিত। স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, ধলহার, কঠুরাকাঠি গ্রাম এবং ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ২২টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। আটঘর-কুড়িয়ানা বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারাসমৃদ্ধ গ্রাম। এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গইয়া কিংবা শবরি বলা হয়। তবে জাতীয়ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা চারটি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।
আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রের অর্ধেক– এই আড়াই মাস জমে ওঠে পেয়ারা বেচাকেনা। পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ছোট-বড় ব্যবসাকেন্দ্র ও হাট। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম। এ মোকামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– আটঘর, কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙিতে করে সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে এসে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। পাইকাররা তা কিনে ট্রাক ও ট্রলারযোগে নিয়ে যান ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। আটঘর-কুড়িয়ানাখ্যাত বাগান থেকে ছোট ও মাঝারি নৌকায় করে বিপুল পরিমাণ পেয়ারা ভিমরুলীর ভাসমান হাটে নিয়ে আসেন চাষিসহ বাগান পর্যায়ের ক্রেতারা। সেখান থেকে পাইকারসহ খুচরা ব্যবসায়ীরা পেয়ারা কিনে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন বাজারে। ট্রলার ছাড়াও লঞ্চ, বাস, পিকআপ ও ট্রাকে করেও ভিমরুলী থেকে পেয়ারা যায় দেশের বিভিন্ন বাজার ও মোকামে। আটঘর-কুড়িআনার এ পেয়ারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গত এক দশক ধরে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার আগরতলা বাজারেও বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, এ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়ারার চাষ হয় পিরোজপুরের নেছারাবাদে। এ উপজেলায় ৬০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে অন্তত ৭ হাজার ৬৫৬ টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। ঝালকাঠি সদরে ৫৯১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৬ হাজার ৩৫৫ টন ও বরিশালের বানারীপাড়ায় ২১০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ২ হাজার ৯৪০ টন পেয়ারা। সব মিলিয়ে এ তিন উপজেলায় এক হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে ১৬ হাজার ৯৫১ টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়; যার দাম প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি।
স্থানীয় প্রবীণ কৃষক লাল মিয়া জানান, ষাট-সত্তর দশকে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো হতো লঞ্চে। আশির দশকে ঝালকাঠি থেকে স্টিমারে তুলে দেওয়া হতো পেয়ারা। নব্বই দশকে বানারীপাড়ার জম্বুদ্বীপ থেকে প্রতিদিন দু-চারটি পিকআপে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো শুরু হয়। পরে ২০১৬ সালে মিনি ট্রাক এবং ২০১৯ সাল থেকে বড় ট্রাকের ব্যবহার শুরু হয়। এখানকার আড়তদারদের মতে, লঞ্চ-ট্রাক যে পথেই পাঠানো হোক, ঢাকার ভোক্তাদের কাছে পেয়ারা পৌঁছাত এক দিন পর। দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়ায় এ সময়ের মধ্যে পেয়ারার রং-স্বাদ নষ্ট হতো। পচে যেত অর্ধেক পেয়ারা। এতে চাষিরা ন্যায্য দাম পেতেন না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এখন সকালে গাছ থেকে সংগৃহীত পেয়ারা দুপুরের আগেই পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকায়। এতে রং-স্বাদ দুটিই থাকছে অটুট।
আটঘর কুড়িয়ানা এলাকার চাষি নিজামুদ্দিন জানান, আগে পেয়ারা আর লেবু বিক্রি করে কম দাম পেতাম। এ কারণে পেয়ারা বাগান পরিবর্তন করে অন্য কিছু চাষাবাদের চিন্তা করছিলাম। এখন সেই চিন্তা বাদ দিয়েছি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে দাম। ফলে আমরা লাভবান হতে শুরু করেছি।
স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ জানান, নেছারাবাদের ২২টি গ্রামে ৬০০ হেক্টর জমিতে গড়ে ১০ টন করে পেয়ারার ফলন হচ্ছে। প্রতি মণ পেয়ারা ৩৫০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেয়ারা বাগানে ফুল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সার্বক্ষণিক মাঠে কৃষি কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের সহায়তায় কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। সার, কীটনাশক ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। পেয়ারা চাষ করে এ অঞ্চলের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।